পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী সাবরি, পিসিকে অবশ্যই স্যালুট দিতে হবে মন্ত্রণালয়ের ঐতিহ্যবাহী উটপাখি নীতি ভাঙার জন্য। আমাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নীরবে ভূরাজনৈতিক অত্যাচার সহ্য করা, কিন্তু এখন তা আর হতে পারে না। গত সপ্তাহে কানাডা শ্রীলঙ্কার দুই সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। স্পষ্টভাষী মন্ত্রী আবাসিক কানাডিয়ান সরকারের প্রতিনিধিকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠাতে সময়ক্ষেপণ করেননি। এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
এর দুই দিন পর বাংলাদেশ ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের জন্য আরো ছয় মাস সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। একজনের আন্তরিক বন্ধু কারা তা এতেই বোঝা যায়। এ ঘটনা আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও বটে। আমাদের সাহায্য ও নির্দেশনার জন্য সর্বদা পশ্চিম দিকে তাকানোর দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা রয়েছে। এটা পরিহাসের বিষয় যে, কানাডা যেদিন শ্রীলঙ্কার চার নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সেদিনই শ্রীলঙ্কার শীর্ষ কর্মকর্তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কলম্বোভিত্তিক কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অগ্রগতির চিত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যা অনেক প্রশংসার সঙ্গেই গৃহীত হয়েছিল।
গত সপ্তাহে ২০২৩ সালের জন্য প্রথম কূটনৈতিক ব্রিফিং দেওয়া হয়। এটি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী সাবরির সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার সঙ্গে ছিলেন বিচার, কারাবিষয়ক ও সাংবিধানিক সংস্কারমন্ত্রী ড. বিজয়েদাসা রাজাপক্ষে পিসি, পর্যটন ও ভূমিমন্ত্রী হারিন ফার্নান্দো, শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. নন্দলাল ওয়েরাসিংহে, পররাষ্ট্রসচিব আরুনি উইজেবর্ধনে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পরিকল্পনা বিভাগের মহাপরিচালক কুমারসিরি। এ সময় মন্ত্রী সাবরি ঘোষণা করেন, শ্রীলঙ্কা ২০২৩ সালকে আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা, পুনর্মিলন ও পুনরুদ্ধারের বছর হিসেবে দেখছে এবং গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রগতির রূপরেখা দিয়েছে।
পুনর্মিলনের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন :তামিল ও মুসলিম দলগুলোর সঙ্গে ‘জাতীয় প্রশ্ন এবং অন্যান্য সম্পর্কিত সংখ্যালঘু সমস্যা’ নিয়ে আলোচনা করার জন্য রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে ডিসেম্বর ২০২২-এ রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন (এপিসি) আহ্বান করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন :৭৫তম স্বাধীনতা উদযাপনের আগে সব রাজনৈতিক দলকে ‘জাতিগত সমস্যার’ সমাধানে একমত হওয়া উচিত। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ঘোষণা করেছে যে রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রিসভাকে পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সর্বদলীয় সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে ব্রিফ করবেন। এজন্য লেসন লার্নড কমিশন, উদুলাগামা কমিশন ও পারনাগামা কমিশনের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নওয়াজ কমিটির রিপোর্ট বিবেচনা করা হবে।
সবার সন্তুষ্টিতে সেই ব্রিফিং শেষ হয়। কূটনীতিকেরা তাদের স্বাগতিক দেশের অগ্রগতি সম্পর্কে তাদের কাছে ও পাশে রাখতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের অত্যন্ত প্রশংসা করেন। তার পরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। কানাডার পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী মেলানি জোলি ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় স্থূল ও নিয়মতান্ত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন।
কথায় বলে, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। বাংলাদেশের ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সম্প্রসারণ কানাডার পদক্ষেপের সরাসরি বিপরীত। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) পরিচালক বোর্ড শ্রীলঙ্কার ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ছয় মাস বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরে আরো ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার দিয়েছে। এটি ২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধ করার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল। সিবিএসএলের গভর্নর ড. নন্দলাল ওয়েরাসিংহে ২০২২ সালের অক্টোবরে বিবি (বাংলাদেশ ব্যাংক)-এর গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ঋণ সময়মতো পরিশোধ করা হবে। তবে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এখনো চলছে। তাই বিবির সময়সীমা সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ যখন দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে, তখনো এর সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ৪৪ দশমিক ৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আইএমএফসহ বেশ কয়েকটি বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণসহায়তা চেয়েছে।
এখানে জেনে রাখা ভালো, শ্রীলঙ্কার দৃঢ় বন্ধু রয়েছে। তারা তাদের মতো নয়, যারা শ্রীলঙ্কাকে তার দুর্বল অবস্থায় ফেলে দিতে দুবার চিন্তা করে না। অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কার অনেক চাওয়া-পাওয়ার আছে। তবু স্পষ্টতই সব বন্ধু অভাবের সময় সেই তালিকার মধ্যে নেই।
লেখক : ডিপুটি ডাইরেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স অ্যান্ড ফরেন মিডিয়া, প্রেসিডেন্টের মিডিয়া বিভাগ, শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার জাতীয় দৈনিক দ্য ডেইলি নিউজ থেকে অনুবাদ :
Leave a Reply